ছড়াকার জগলুল হায়দার সৃষ্টি করেছেন উত্তরাধুনিক ছড়া। কবি আসাদ চৌধুরী বলেছেন, মডার্নিজমের মাধ্যমে কলুষিত করা সমাজকে জগলুল হায়দার ছড়ার মাধ্যমে কষাঘাত করেন। বাংলা ভাষার ছড়া সাহিত্যের অন্যতম ও অনিবার্য এই ছড়াকার জন্মেছেন ১৯৬৫ সালে। আজ ৮ অক্টোবর ছড়াকা জগলুল হায়দারের ৫৫তম জন্মদিন আজ। তাঁকে নিয়ে লিখেছেন ভারতের পশ্চিমবাংলার ছোটকাগজ ‘চড়ুই’ পত্রিকার সম্পাদক
তারক চট্টোপাধ্যায়
ছোটবেলায় বাবার হাত ধরে রবীন্দ্রভবনে গেছিলাম জুনিয়র পি.সি.সরকারের জাদুর খেলা দেখতে। মোহিত হয়ে দেখেছিলাম। মুগ্ধ হয়ে কাটিয়েছিলাম বেশ কয়েকটি দিন। আবার বড় হয়ে ছড়ার পত্রিকা করতে গিয়ে ফেসবুকে আলাপ হয় ‘জাগলার জগলুল’ এর সাথে। দেখি বাংলাদেশের ঢাকায় একজন পোলা শব্দ নিয়ে বেশ জাগলারী দেখাচ্ছে অসম্ভব দক্ষতায়। বেশ ভালো লাগল। পুরো নাম জগলুল হায়দার। আস্তে আস্তে জানলাম তার রকমারী কীর্তির কথা।
তিনি বাংলাদেশ ছড়া একাডেমী’র উদ্যোক্তা পরিচালক এবং একই সাথে কবিতা আন্দোলন ম্যাজিক লন্ঠনেরও সম্পাদক। বলাই বাহুল্য এই মানুষটি বর্তমানে বাংলাদেশের একজন জনপ্রিয় ছড়াকার। বাংলাদেশের বহুল প্রচলিত বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা এবং খবরের কাগজে প্রতিনিয়ত তার ছড়া স্থান পায় অত্যন্ত সাদরে। ইতোমধ্যে বিভিন্ন প্রকাশনী সংস্থা তার লেখা নিয়ে বেশ কয়েকটি বইও প্রকাশ করেছে। তার মধ্যে ‘বিকেল খেকো টাওয়ার’, ‘হাউ মেনি পেডি টু হাউ মেনি রাইস’, ‘ভেঙে যায় কথা কাচ’, ‘ভালোবাসার ১০০ লিরিক’ ইত্যাদি।
‘জগলুল হায়দার এর বারোভাজা’ এর স্বাদ যে এত অপূর্ব তা না পড়লে বোঝানো অসম্ভব। তার যেমন বাকচাতুর্য আছে তেমনি রসবোধ এবং ব্যাঙ্গ করার পারদর্শিতা, অন্যদিকে আবার সরল প্রেমের রস গড়িয়ে পড়ে চার লাইনের মধ্যে-
‘আমরা গড়েছি কথার সাগর
ফেনিল শব্দ ঢেউ
কুড়িয়ে ঝিনুক সন্ধ্যা করেছি
কতো দিন, জানে কেউ?’
আবার সুন্দর অবলীলাক্রমে বলেন,
‘পেন্ডুলামের ধর্ম এটাই
এপাশ ওপাশ দুলবে
সে থাকবে থির কখন
এইটা ভাবাই ভুল বে!’
বা,
‘রক্ত কখনো যায় না বৃথা
ইতিহাস দেয় সাক্ষ্য
হাজার কথার মরণেই হয়
কবিতা অমর বাক্য।’
আমি সৌভাগ্যবান যে এত শক্তিশালী একজন কবির সান্নিধ্য পেয়েছি। ফেসবুকের মাধ্যমে তার সাথে যখন চ্যাট হয় আমার তখন মনে হয় এই তো পাশেই বসে আছেন তিনি। তবে যার জন্য তিনি এত আমার আদরের মানুষ তা হলো তার ছন্দের কারসাজি। কী অসম্ভব নিপুণ হস্তে শব্দ নিয়ে লোফালুফি খেলেন তিনি। বৈশাখ মাস নিয়ে অসম্ভব সুন্দর ছন্দে তার ছড়া ‘এমন দিনে’র কয়েকটি লাইন-
‘ঝুনঝুনি আর ঢোলক ঢাক
দুই পয়াসার নোলক-নাক
ইষ্টি বাড়ি মিষ্টি হাড়ি
আকাশ মেয়ের বিশটি শাড়ি।’
বিষয়ের বৈচিত্র্যে, ছন্দে এবং অন্তমিলে জগলুল হায়দার স্বমহিমায় উজ্জ্বল। প্রতিনিয়ত পরীক্ষা নিরীক্ষা, নতুনত্বের উদ্ভাবন তার ছড়ায় দেখতে পাওয়া যায়। বাংলাদেশের মহানায়ক শেখ মুজিবর রহমানকে নিয়ে লিখলেন ‘সেই খোকা’
‘একটা খোকা
একটা দেশ
লাল-সবুজে হয় সজীব
একটা খোকাই
লক্ষ খোকা
সেই খোকাটাই শেখ মুজিব।’
আবার ঔপন্যাসিক হুমায়ুন আহমেদকে নিয়ে লেখা ‘ভাটির পোলা’–
‘সত্যি তুমি ভাটির ছেলে
এই অভাগা মাটির ছেলে
কলম ধরে হাতে
দেখিয়ে দিলে উভয় পারে
শক্তি কত তাতে।’
শক্তি আছে জগলুল ভাইয়ের, না হলে এত অফুরান ছন্দ, ঠাট্টা, ভালোবাসা আসে কোথা থেকে? ‘প্রেমের হিরো’ ছড়াটির ছন্দের তাল মনে দাগ কাটার মতো,
‘জল ছিপ ছিপ
কচুর পাতায়
বিস্টি খেলে সিলিপ,
বেনি করা চুলে মেয়ের
মিষ্টি দুটো কিলিপ।’
সত্যি ছড়ার জাদুকর ‘জাগলার জগলুল’ হায়দার তিনি। তার ৫৫তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষ্যে শুধু এই কামনা করি তিনি যেন সেঞ্চুরি করেন এবং তার কলম থেকে ছন্দের ফুলঝুরিতে দুই বাংলার আকাশ আলোকিত হয়। অবশেষে তারই লেখা একটি ছড়া দিয়ে শেষ করি, ‘ছড়ার কাছে’- জগলু দাশের দাসত্ব / ছড়ার কাছে? তা সত্য।’
লেখক: ছোটকাগজ ‘চড়ুই’ সম্পাদক, পশ্চিমবাংলা, ভারত।