মুক্তিযুদ্ধের আগে ভিসি বা শিক্ষকরা যদি তখনকার ক্ষমতাসীন ইয়াহিয়া, আইয়ুব খানের তাঁবেদারি করতেন, তাহলে বাংলাদেশের ছাত্ররা ’৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন বা ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ করতে পারত না। যদি লেজুড়বৃত্তির রাজনীতি হতো তাহলে বোস প্রফেসর মতিন চৌধুরীর মতো প্রফেসর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি হতেন না। ’৯০-এর আগে ভিসি বা শিক্ষকরা একটা আদর্শিক অবস্থানে ছিলেন বলেই মান্না, আখতারুজ্জামানরা জাসদ করেও ডাকসুর ভিপি হয়েছেন। ছাত্র রাজনীতি তখন ভিপি বানাত না।
’৯০-এর পর ছাত্র রাজনীতি দলভিত্তিক, লেজুড়বৃত্তিক হওয়ার কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি, প্রক্টোর, প্রভোস্ট, প্রশাসন এমনভাবে দলীয় রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে যে, শিক্ষক রাজনীতি এবং ছাত্র রাজনীতি একাকার হয়ে যায়। আদর্শহীন, মেধাহীন শিক্ষকরা এ রাজনৈতিক ছাত্রদের ব্যবহার করতে শুরু করে। ছাত্ররাও শিক্ষকদের বিভিন্ন পদ-পদবি পাইয়ে দেয়ার আশ্বাসে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস-হলে আধিপত্য বিস্তার শুরু করে।
নতজানু প্রশাসনের কারণে এ ছাত্ররা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে টেন্ডার ও চাঁদাবাজিতে জড়িয়ে পড়ে। শিক্ষকদের তোষামোদী ও আশকারা পেয়ে ছাত্ররা ক্রমশ শক্তিশালী ফ্রাঙ্কেনস্টাইন দানবে পরিণত হয়। এরই ফলে এরা প্রত্যেক হলে গড়ে তোলে নিজস্ব বাহিনী। ভীরু, তোষামোদকারী, দুর্নীতিবাজ শিক্ষকরা এদের ভয়ে তখন আর কোনো কিছু বলতে পারে না। তাই ছাত্ররা হয়ে ওঠে একেকজন প্রভাবশালী, গাড়ি-বাড়ি, অস্ত্রধারী বড় ভাই। আর সেই মুহূর্তে এদের ব্যবহার করতে থাকে রাজনৈতিক দলের বড় বড় নেতা ও মন্ত্রীরা। এমনকি সিভিল প্রশাসনের লোকজন ও পুলিশও বড় বড় পদ-পদবি পাওয়ার জন্য এদের ব্যবহার করতে থাকে।
ফলে আদর্শহীন শিক্ষক, পুলিশ, প্রশাসন, রাজনৈতিক নেতা, মন্ত্রী এবং এ অস্ত্রধারী ও প্রভাবশালী ছাত্ররা হয়ে যায় একাকার- ‘একই বৃত্তে শতফুল’। তাই হলে হলে তৈরি হয় টর্চার সেল। প্রশ্ন হল, বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন থাকবে গণরুম, কেন একজন ছাত্র দূরদূরান্ত থেকে এসে ভর্তি হয়ে হলে থাকার অধিকার পাবে না? দলবাজ, নীতিহীন, মেধাহীন শিক্ষকরা একবারও ভাবেন না- এই ছেলেমেয়েরা বাবা-মায়ের কোল ছেড়ে সুদূর তেঁতুলিয়া, পঞ্চগড়, টেকনাফসহ ৬৪টি জেলার প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে এসে ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন ভর্তি হয়, তখন তাদের প্রয়োজন আশ্রয়, অভিভাবক ও সহমর্মিতা।
একজন অভিভাবক হিসেবে শিক্ষকদের উদ্দেশে আমি বলব, আমি তো একজন মেধাবী সন্তানকে ১৮ বছর লালন-পালন করে আপনাদের হাতে তুলে দিয়েছিলাম, আপনারা তাকে পরবর্তী চার বছরে মানুষের মতো মানুষ করবেন, শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠে শ্রেষ্ঠ সম্পদ তৈরি করবেন, আলোকিত মানুষ তৈরি করবেন বলে। যে আলোর বিচ্ছুরণে দেশ ও জাতি এবং সারা বিশ্ব আলোকিত হবে। কিন্তু এমন কী হল, এক-দুই বছরের মাথায় আমার মেধাবী সন্তানটি হয়ে গেল দানব? আমার ছেলেটি ছিল কোমলমতি কিশোর, আপনাদের অভিভাবকত্বে তার হাতে কলমের বদলে অস্ত্র কীভাবে উঠে এল? বই-খাতার বদলে টেন্ডারের কাগজ কীভাবে উঠে এল? কীভাবে তারা সহপাঠী আবরারকে ৬ ঘণ্টা পিটিয়ে পিটিয়ে হত্যা করল? এসব প্রশ্ন আজ আপনাদের আমি করছি। আমি জানি উত্তরটা আপনারা দেবেন না।