মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মূল্যবোধ রক্ষা করতে হবে

সম্পাদকীয়

আজ ১৬ ডিসেম্বর। মহান বিজয় দিবস। এ দেশের ইতিহাসে এক গৌরব ও অহংকারের দিন। ১৯৭১ সালের এই দিন বিশ্বের মানচিত্রে জন্ম হয় বাংলাদেশ নামে স্বাধীন-সার্বভৌম নতুন একটি দেশের। কালের বিবর্তনে এ বছর আমরা সেই দীর্ঘ রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে অর্জিত বিজয়ের ৫১ বছরে পদার্পণ করেছি।

১৯৭১ সালের এই দিনে ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধ শেষে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) আত্মসমর্পণ করেছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শেষে বাঙালি জাতি স্বাধীনতা সংগ্রামে চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করে। সেদিন জাতি নির্ভয়ে গেয়ে উঠেছিল অবিনাশী গান—‘একটি বাংলাদেশ তুমি জাগ্রত জনতার/ সারা বিশ্বের বিস্ময় তুমি আমার অহংকার।’

তারই ধারাবাহিকতায় বাঙালি প্রতিবছর ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস হিসেবে পালন করে আসছে। জাতি শ্রদ্ধাবনতচিত্তে স্মরণ করছে পরাধীনতার শৃঙ্খল মুক্তির সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়া শহীদদের। স্মরণ করছে যেসব নারী ভয়াবহ নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন, তাদের।

এ দেশের মানুষের আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক অধিকার তথা স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে সফল নেতৃত্ব দেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। কোটি কোটি মানুষকে তিনি স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত করে তুলেছিলেন। তার সঙ্গে ছিলেন একই লক্ষ্যে অবিচল একদল রাজনৈতিক নেতা। তাদের সবাইকেই আমরা গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি।

স্বাধীন বাংলাদেশের যাত্রা শুরু হয়েছিল একরাশ স্বপ্ন বুকে নিয়ে। ৫১ বছরের এ পথপরিক্রমায় সে স্বপ্নের কতটা পূরণ হয়েছে, আজ সে হিসাব মেলাতে চাইবে সবাই। এর মধ্যে আমাদের অনেক ঘাত-প্রতিঘাত মোকাবিলা করতে হয়েছে। রাজনীতি এগিয়েছে অমসৃণ পথে। সামরিকতন্ত্র, সাম্প্রদায়িকতা অশক্তি ও অগণতান্ত্রিক শক্তির হস্তক্ষেপে বারবার ব্যাহত হয়েছে আমাদের গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রা।

এ সত্ত্বেও বর্তমান সরকারের আমলে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ার শর্ত পূরণ করেছে বাংলাদেশ। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বেড়েছে। তবে দারিদ্র্য এখনো প্রকট। গণতন্ত্রকে সর্বস্তরে পৌঁছে দেওয়ার ব্যাপারে অঙ্গীকারের অভাব পীড়াদায়ক। রাজনৈতিক অঙ্গনে গভীর বিভক্তি; এর পাশাপাশি জাতীয় প্রশ্নে অনৈক্য আমাদের এগিয়ে যাওয়ার পথে বড় বাধা হয়ে রয়েছে।

দেশে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি এখনো তৎপর। যুদ্ধরত ঐক্যবদ্ধ বাঙালির লক্ষ্য ছিল শুধু দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীকে বিতাড়িত করা নয়, শুধুই স্বাধীনতা অর্জনও নয়; চূড়ান্ত লক্ষ্য ছিল একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করা, যেখানে পাকিস্তানি শাসনামলের সব অন্যায়-অবিচারের চির অবসান ঘটবে; যেখানে রাষ্ট্র পরিচালিত হবে অবাধ, সুষ্ঠু ও পক্ষপাতহীন নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের দ্বারা সত্যিকারের গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে; যেখানে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব নাগরিক সমান রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় অধিকার ভোগ করবে; যেখানে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হবে, অর্থাৎ সব আইন সবার জন্য সমানভাবে প্রয়োগযোগ্য হবে।

তবে আশার কথা, একাত্তরের চিহ্নিত মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার ও রায় কার্যকরও হয়েছে। এতে স্বাভাবিকভাবেই আশা করা যায়, সমগ্র বিচার সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হলে তা এ ধরনের অপশক্তির তৎপরতা রোধে সহায়ক হবে। সেই সঙ্গে আইনের শাসন জোরদার করার পথও সুগম হবে। নিশ্চিত হবে মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি। বিজয় হয়ে উঠবে অর্থবহ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *