প্রথম চা গাছ রোপণ থেকে ধরলে বাংলাদেশে চা শিল্পের বয়স ১৭৮ বছর। সুদীর্ঘ এ সময়ে দেশের মানচিত্র বদলেছে দুবার। কিন্তু, চা শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি এখনো ১৭৮ টাকাও করা যায়নি। মূল্যস্ফীতির বাজারে যেখানে ডিমের হালি ৫৫ টাকা, সেখানে দিনে ২৩ কেজি চা পাতা তোলা একজন শ্রমিকের ৩০০ টাকা মজুরির ন্যায্য দাবির বিপরীতে সরকার মাত্র ১৪৫ টাকা নির্ধারণ করেছে। চা শ্রমিকরা ৯ আগস্ট থেকে বর্তমান মজুরি দৈনিক ১২০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ন্যূনতম ৩০০ টাকা করার দাবিতে কর্মবিরতি পালন করে আসছিলেন। কিন্তু চা বাগান মালিকদের সংগঠন তাতে কর্ণপাত না করে উল্টো সংবাদমাধ্যমে দাবি করেছে, চা শ্রমিকরা ১২০ টাকা মজুরিতেই ভালো আছেন। বর্তমানের এই উচ্চ বাজার মূল্যের সময় দৈনিক এই মজুরিতে একটি পরিবার কেন, একজন ব্যক্তির একারও পেট চালানো দায়। সেখানে মালিকদের এই মনোভাব প্রচ- অমানবিক। মালিকরা মজুরি ১৪ টাকা বাড়িয়ে ১৩৪ টাকা করার প্রাথমিক প্রস্তাব দিয়েছিলেন। এরপর অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘটের অষ্টম দিন শনিবার চা শ্রমিক নেতৃবৃন্দের সঙ্গে শ্রম অধিদপ্তরের বৈঠকে চা শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি মাত্র ২৫ টাকা বাড়িয়ে ১৪৫ টাকা করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। বৈঠকের পর বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির নেতারা ধর্মঘট প্রত্যাহারের ঘোষণা দিলেও সাধারণ শ্রমিকরা ১৪৫ টাকা মজুরি প্রত্যাখ্যান করে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। আন্দোলনরত সাধারণ শ্রমিকরা শনিবার সন্ধ্যা থেকেই ঢাকা-সিলেট মহসড়কের কয়েকটি স্থানে অবস্থান নিয়ে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন।
দেশের প্রচলিত আইনে একজন কৃষিশ্রমিকের ন্যূনতম মজুরি ৩ কেজি ৩৭০ গ্রাম চালের সমপরিমাণ। গ্রামের একজন মজুরকে সারা দিনের জন্য মজুরি দিতে হয় কমপক্ষে ৪০০ থেকে ৬০০ টাকা। এ ছাড়াও, শ্রম মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন নিম্নতম মজুরি বোর্ড বিভিন্ন খাতের যে ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করেছে তা আরও বেশি। প্রতি বছর বেতন বৃদ্ধির বিধানও রয়েছে। যদিও তা মানা হয় না। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে চা-শ্রমিকদের ন্যূনতম দৈনিক মজুরি ২৩২ রুপি যা বাংলাদেশি টাকায় ২৭৭ টাকা। কিন্তু ভারতের শ্রমিকরাও বর্তমান বাস্তবতায় মজুরি বৃদ্ধির দাবি করছেন। সর্ববৃহৎ চা রপ্তানিকারক দেশ শ্রীলঙ্কা, নেপাল, কেনিয়া ও চীনে দৈনিক মজুরি বাংলাদেশের চা শ্রমিকদের দাবিকৃত মজুরির চেয়েও অনেক বেশি। চা-বোর্ডের তথ্য অনুসারে দেশের ১৬৭ চা বাগানে শ্রমিক ও শ্রমিকদের পরিবার মিলিয়ে ৫ লাখের বেশি মানুষের বাস। এদের মধ্যে স্থায়ী শ্রমিক প্রায় এক লাখ। একজন শ্রমিকের মজুরির ওপর কমপক্ষে ৫ জন নির্ভর করে। সরকারি তথ্য অনুসারে, দেশে মাথাপিছু বাৎসরিক আয় ২ হাজার ৮২৪ ডলার অর্থাৎ ২ লাখ ৬৮ হাজার ২৮০ টাকা। সেখানে চা-শ্রমিকদের বার্ষিক আয় মাত্র ৪৩ হাজার ২০০ টাকা।
ব্রিটিশরা শুরুর দিকে বিভিন্ন স্থান থেকে শ্রমিকদের নিয়ে এসে চা বাগানের আবাদ শুরু করলেও পরে আর তার দরকার হয়নি। কারণ এই শ্রমিকদের সন্তানরাই পরবর্তীকালে বংশপরম্পরায় চা বাগানের কর্মী হিসেবে কাজ করে যাচ্ছেন। পরবর্তী প্রায় দুই শতকে চা শিল্পের ব্যাপক বিস্তার ঘটলেও সেই পরিস্থিতির বদল হয়নি। বাংলাদেশের চা-শ্রমিকদের পরিস্থিতিকে ‘আধুনিক দাসত্ব’ আখ্যা দিয়ে বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘দেড় শ বছর পরেও বাংলাদেশের মূল সমাজের সঙ্গে তাদের সংযোগ খুবই সামান্য। শিক্ষা আর চাকরি সুযোগের অভাবে তারা চা বাগানেই আটকে রয়েছে। বাইরে অচেনা একটি দেশে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের ভয় তাদের অদৃশ্য শেকলে চা বাগানের মধ্যে আটকে রেখেছে।’
আমাদের অবহেলায় পাটের সুদিন গেল। গেল চিনির রাজত্বও। চামড়া শিল্পের শেষ পরিণতি দেখাও হয়তো সময়ে ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে। অতঃপর, শ্রমিক অসন্তোষ ও প্রতিযোগিতার বাজারে দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক চাহিদার নিরিখে চা শিল্পের পরিণতিও একই পথে যাচ্ছে কিনা সেটাও বিবেচনায় রাখা জরুরি। ২০২০ সালের শ্রমিক এবং মালিকদের সর্বশেষ চুক্তি অনুযায়ী, ২০২১ সালের ১ জানুয়ারি থেকে চা-শ্রমিকদের মজুরি বাড়ানোর কথা। কিন্তু দেড় বছর পেরিয়ে গেলেও মালিকরা তা করেননি। এখন নিরুপায় চা শ্রমিকরা আন্দোলন শুরু করলে সরকার তাদের মজুরি ১২০ থেকে ২৫ টাকা বাড়ানোর যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে সেটা মোটেও যথেষ্ট নয়। আমাদের কথা সুস্পষ্ট তেলের দাম বাড়লে যদি সরকার পরদিনই ভাড়া সমন্বয় করতে পারে, গার্মেন্টস মালিকদের দাবির সঙ্গে সঙ্গে প্রণোদনা দিতে পারে, তাহলে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা রপ্তানিমুখী চা-শিল্পের চা শ্রমিকরা কেন ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত হবেন? আমরা মনে করি, সরকারে উচিত অবিলম্বে চা শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরির দাবি পুনর্বিবেচনা করা।